রাজনৈতিক অর্থনীতির দুষ্ট চক্রে আটকা দেশ

প্রকাশিত: ৮:৩৮ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ৪, ২০১৯

রাজনৈতিক অর্থনীতির দুষ্ট চক্রে আটকা দেশ

ডায়ালসিলেট ডেস্ক:রাজনৈতিক অর্থনীতির দুষ্ট চক্রে আটকা পড়েছে দেশ। ব্যাংক ঋণের টাকা ফেরত না দেয়া, কর ফাঁকি, বিদেশে অর্থ পাচার, পুঁজিবাজারের টাকা হাতিয়ে নেয়া এবং সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি- এসব অর্থনীতির সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে প্রায় সব খাতেই ঘাটতি। আর এই ঘাটতি পূরণে বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। অন্যদিকে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিসহ (জিডিপি) বিভিন্ন অস্বচ্ছ পরিসংখ্যান দিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। বেসরকারি সংস্থা বা সংবাদমাধ্যমে এসব ক্ষেত্রের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত হলেও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে অস্বীকৃতির মনোভাব তৈরি হয়েছে। এসব কারণে গত ১০ বছরের মধ্যে সামষ্টিক অর্থনীতি সবচেয়ে বেশি চাপে রয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের বিভিন্ন সূচকের ভিত্তিতে দেশের অর্থনীতি নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মূল্যায়নে এসব বিষয় উঠে এসেছে। রোববার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এই মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ড. মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এবং সিনিয়র রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।

তারা বলেন, জিডিপির হিসাবে সুতা ছাড়া ঘুড়ির মতো। এর সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। কী তথ্যের ভিত্তিতে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হিসাব করা হয় তা জনগণের সামনে প্রকাশ করা উচিত। এছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক খাতে দুর্নীতি বন্ধ না করে ক্যাসিনো বন্ধের অভিযান সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’

অনুষ্ঠানে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাস (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) আমরা চারটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। এর মধ্যে রয়েছে রাজস্ব খাত, ব্যাংক, শেয়ারবাজার এবং বৈদেশিক খাত। এসব ক্ষেত্রে আমরা প্রতিবন্ধকতার শিকার। একটি বিষয় পরিষ্কার করতে চাই, দেশে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন দফতর থেকে যেসব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এরপরও যতটুকু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে, তার নির্ভরযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সঠিক তথ্য-উপাত্ত না পেলে অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে এক ধরনের স্বচ্ছতার অভাব দেখা দেয়।’

তিনি বলেন, আমাদের ধারণা এই অস্বচ্ছতার অভাব সরকারের নীতিনির্ধারকদের সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত করে। কারণ বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই সরকারি পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফলে বিভ্রান্তিকর তথ্যের কারণে তারা সঠিক ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে, তার ফলাফল সম্পর্কেও জানতে পারেন না। এসব কারণে আমরা বলছি, বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের কারণে সরকারই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর এর মূল্য দিচ্ছে দেশের মানুষ। এতে সিপিডির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও মুক্তভাবে গবেষণার ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।’

ড. দেবপ্রিয় বলেন, গবেষণার ভেতর দিয়ে অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা ও সমন্বয়ের অভাব উঠে এসেছে। বর্তমানে দেশে এক নীতিকেন্দ্রিক ব্যবস্থা চলছে। সরকার শুধু রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগনীতিতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির মধ্যে নিয়ে এসেছে। যে ধরনের বিনিয়োগের কথা বলা হচ্ছে, তা সরকারিভাবে অবকাঠামো খাতে। এর সঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগ, রাজস্ব আদায়, মুদ্রানীতি, টাকার মূল্যমান, আয়-ব্যয় এবং অন্যান্য বাণিজ্যনীতির সম্পর্ক খুবই দুর্বল।’

তিনি বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতিতে নেতৃত্বমূলক ভূমিকা থাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সামষ্টিক অর্থনীতির নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে চিন্তাভাবনা না করে বিভিন্ন মহলের প্রভাবে এডহক ভিত্তিতে আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারণ করা হচ্ছে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির ফলাফল শুভ হচ্ছে না।’

তিনি বলেন, আর্থিক খাতের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত কেন্দ্র থেকে নেয়া হচ্ছে। ফলে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বা মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা গৌণ হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন পরিসংখ্যানে বিভ্রান্তি রয়েছে। তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আলাপ-আলোচনা না করে সাধারণভাবে একটি গল্প (আখ্যান) দাঁড় করানো হয়। এসব গল্প অর্থনৈতিক বিবেচনায় আমাদের কাছে বস্তুনিষ্ঠ মনে হয় না। কিন্তু অন্য কোনো সংস্থা থেকে বিশ্লেষণ দেয়া হলে বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে থেকে অস্বীকার করা হয়।’

জিডিপি প্রবৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে সিপিডির বিশেষ ফেলো বলেন, সাধারণ সেন্সে দেখা যাচ্ছে, গত কয়েক বছর পর্যন্ত দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২৩ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করছে। কিন্তু জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ৫ থেকে ৬, ৭ ও ৮ চলে গেছে। বেসরকারি বিনিয়োগ না বেড়ে প্রবৃদ্ধি কীভাবে বাড়ল, তা জানা ও বোঝার জন্য একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমি খুবই পুলকিত ও চিন্তিত হয়ে আছি। আরেকটি বিষয় হল- বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ স্মরণকালের সবচেয়ে কম। এরপর ব্যবসায় লোকসান দেখিয়ে ঋণ গৃহীতারা ব্যাংকের টাকা ঠিকমতো ফেরত দিচ্ছে না। শেয়ারবাজারে বড় ধরনের সংকট। লোকসানের কারণে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের দাম কমছে। আমদানিসহ পুঁজি পণ্য আসার ক্ষেত্রে নেতিবাচক অবস্থা। এসব কিছুর পরও সরকার বলছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। প্রবৃদ্ধির তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। এছাড়া সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ছে না। প্রশ্ন হল, এত প্রবৃদ্ধি হলে আয় গেল কোথায়। এক্ষেত্রে সিপিডির ব্যাখ্যা হল বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি একটি সুতা কাটা ঘুড়ি বা বেলুনের মতো। সহজভাবে বললে, প্রবৃদ্ধি নিরূপণের ক্ষেত্রে যেসব তথ্যের দরকার হয়, বাস্তবে সেটি নেই।’

তিনি বলেন, আমি পরিষ্কারভাবে বলছি, সরকারের যেসব সংস্থা প্রবৃদ্ধির হিসাব তৈরি করে, তারা প্রকাশ্যে এসে, তাদের মূল্যায়নের ভিত্তিগুলো জনগণের সামনে উপস্থাপন করেন। আমরা এ ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য প্রস্তুত। এরপর বোঝা যাবে, বাংলাদেশের উন্নয়ন কোন দিকে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের শত্রুতে পরিণত হয়েছে।’

দেবপ্রিয় বলেন, রাজনৈতিক অর্থনীতির দুষ্ট চক্রে আটকা পড়েছে দেশ। হয় কর ফাঁকি, না হয় বিদেশে টাকা পাচার, না হলে ব্যাংকের টাকা ফেরত না দেয়া এবং বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে ১০ টাকার জিনিস কীভাবে হাজার টাকায় কেনা হচ্ছে। এর ফলে পুরো ব্যবস্থায় এক ধরনের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এতে সরকার হয় টাকার সঞ্চার বা কর রেয়াতসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অর্থনীতির ভেতরে এক ধরনের প্রণোদনার আসক্তি তৈরি করছে। এর বড় কারণ হল সরকার আয়ের স্বার্থে কোনো সংস্কার করছে না, তার ক্ষতিপূরণ হিসাবে এই ধরনের ব্যয় করছে। কিন্তু সরকারের এই প্রণোদনা দেয়ার ক্ষমতা সীমিত হয়ে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, নির্বাচনী ইশতেহারে আর্থিক খাতে সংস্কারের জন্য যেসব প্রণোদনার কথা বলা হয়েছিল, আমরা সেটির বাস্তবায়ন দেখিনি। অর্থাৎ সংস্কার না হওয়ায় যারা লাভবান হচ্ছে, তারা এই পরিবর্তনগুলো আনতে দিচ্ছে না। এই তারা হলেন- অর্থ পাচারকারী, কর ফাঁকিবাজ, ব্যাংকের টাকা লুটপাটকারী, শেয়ারবাজারে ফটকাবাজ এবং সরকারি প্রকল্পের টাকা লুটকারীরা। এরা সংস্কারের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই রাজনৈতিক অর্থনীতির দুষ্ট চক্র ভাঙতে না পারলে, পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে।’

দেবপ্রিয় বলেন, ক্যাসিনো অর্থনীতির বিষয়টি সামনে আসছে। কিন্তু ক্যাসিনোর অর্থ বিভিন্নভাবে আসছে। করফাকি, ব্যাংক ঋণ এবং বিদেশে পাচারসহ বিভিন্ন অবৈধ মাধ্যম এই টাকার উৎস। এই উৎস বন্ধ না করলে ক্যাসিনো বন্ধ হবে না।’

তিনি বলেন, ফৌজদারি মাধ্যমে দুর্নীতি দূর করা সম্ভব নয়। কারণ এই মাধ্যমের সীমাবদ্ধতা অনেক বেশি। এ কারণে আমরা চাচ্ছি অর্থনীতিতে সংস্কার আনতে হবে। এই সংস্কার ছাড়া ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’

তিনি বলেন, আমরা বাজেটের আগের টাকার মূল্যমান কমানোর কথা বলেছিলাম। ওই সময় এটি বাস্তবায়ন হলে রেমিটেন্স এবং রফতানিতে প্রণোদনা দেয়ার দরকার ছিল না।
দেবপ্রিয় বলেন, অত্যন্ত চিন্তাভাবনা করে দেশের অর্থনীতির ভেতর থেকে চারটি বিষয় আমরা সামনে নিয়ে এসেছি। এর মূল লক্ষ্য নেতিবাচক সমালোচনা নয়। বাজেট যাতে পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন হতে পারে, সেজন্য সরকারকে সহায়তা করা। আশা করছি সরকার এই বক্তব্যগুলো ইতিবাচকভাবে নিয়ে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে।’

ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘অর্থনীতির অন্যান্য খাতের অবস্থা খারাপ থাকলেও এতদিন বৈদেশিক খাত ভালো ছিল। কিন্তু বর্তমানে এ খাতেও কালো মেঘ দেখা দিয়েছে। দেশের অর্থনীতির আকার ৩০০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১২০ বিলিয়ন ডলারই কোনো না কোনোভাবেই বিদেশের সঙ্গে যুক্ত। ফলে এ খাতে গুরুত্ব দেয়া উচিত।’

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। বর্তমানে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলছে, ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা।’ তিনি বলেন, ‘সরকারের ঘোষিত ঋণ দিয়েই ৩টি পদ্মা সেতু করা সম্ভব।’

ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘শেয়ারবাজারে দুষ্ট চক্রের দুষ্ট কার্যক্রম নতুন করে শুরু করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারল্য সংকটের কারণে বাজারে সমস্যা। কিন্তু এটি ঠিক নয়। কারণ মূল সমস্যা সুশাসনের অভাব। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও নেই। এছাড়া কোম্পানিগুলোর আয় কমছে। আগের বছরের চেয়ে ২০১৯ সালে ৫২টি কোম্পানির লভ্যাংশ কমেছে। ২৩টি কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশই দিতে পারেনি।’

তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতি বড় ধরনের চাপে রয়েছে। রাজস্ব আহরণ ওইভাবে বাড়ছে না। বর্তমানে যেভাবে আদায় হচ্ছে বছর শেষে তাতে ৮৭ হাজার ২২৭ কোটি টাকা ঘাটতি থাকবে। এতে বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের ব্যাংকের ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে। যা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ঋণ পেতে আরও সমস্যা তৈরি করবে।

0Shares