উম্মতের জন্য নবীজির কান্না

প্রকাশিত: ৬:১১ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২, ২০২০

উম্মতের জন্য নবীজির কান্না

কান্না মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ব্যক্তি কেঁদে স্বস্তি পায়। আবার জীবনের নানা মুহূর্তে মানুষ কান্না করে। কান্না আল্লাহর অনুগ্রহও বটে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনি হাসান এবং তিনি কাঁদান।’ (সুরা : নাজম, আয়াত : ৪৩)

মহান আল্লাহর ভয় ও পরকালের চিন্তায় কান্না করেছেন মহানবী মুহাম্মদ (সা.)। হাদিসের ভাষায় রাসুলের কান্নার চিত্র তুলে ধরেছেন সাহাবিরা। নানা সময় রাসুল (সা.)-এর কান্নার প্রসঙ্গ নিম্নে আলোকপাত করা হলো—

 

নামাজে রাসুলের কান্না : উবাইদ বলল, মা, প্রবীণরা বলতেন, ‘দেরিতে সাক্ষাৎ করো, ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে।’ তিনি বলেন, তোমাদের দুর্বোধ্য কথাগুলো রাখো। ইবনে উমাইর বলল, আপনার দেখা রাসুল (সা.)-এর বিস্ময়কর কিছু আমাদের বলুন। কিছুক্ষণ নীরব থেকে তিনি বলেন, এক রাতে রাসুল (সা.) বললেন, হে আয়েশা, আমাকে ছাড়ো। আমার রবের ইবাদত করব। আমি বললাম, আল্লাহর শপথ, আপনার সান্নিধ্যে থাকতে ভালোবাসি। আপনাকে আনন্দিত দেখতে পছন্দ করি। তিনি উঠে অজু করেন। অতঃপর নামাজ আদায় করেন। তখন কাঁদতে কাঁদতে তাঁর কোল ভিজে যায়। তিনি তখন বসা। অশ্রুতে তাঁর দাড়ি ভিজে যায়। এরপর জমিনও ভিজে যায়। বিলাল (রা.) এসে তাঁকে নামাজের জন্য ডাকেন। রাসুলকে কাঁদতে দেখে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি কেন কাঁদছেন, অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বাপর সব গুনাহ ক্ষমা করেছেন। তখন তিনি বললেন, ‘আমি কি একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হব না?’ রাতে আমার ওপর এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। কেউ তা পাঠের পরও চিন্তা না করলে তার জন্য ধ্বংস। আল্লাহ বলেন, আসমান-জমিন সৃষ্টি ও দিন-রাতের আবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন আছে।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৯০)

 

কোরআন শুনে রাসুলের কান্না : অন্যের কোরআন তিলাওয়াত শুনে রাসুল (সা.) কান্না করতেন। আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) আমাকে বলেন, আমাকে কোরআন পড়ে শোনাও। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আপনার ওপর কোরআন অবতীর্ণ হয়। আমি আপনাকে কোরআন পড়ে শোনাব। তিনি বললেন, আমি অন্যদের কাছ থেকে কোরআন শুনতে পছন্দ করি। আমি সুরা নিসা পাঠ করি। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন আমি সব উম্মতের একজন সাক্ষী আনব এবং আপনাকে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদাতা হিসেবে আনব তখন কেমন হবে?’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৪১)

এই আয়াত পাঠ করে আমি মাথা তুলি। দেখি, তাঁর দুচোখ অশ্রুসিক্ত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫০৫৫)

 

কবর জিয়ারতের সময় কান্না : কবর দেখলে রাসুল (সা.) কান্না করতেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) নিজ মায়ের কবর জিয়ারত করে কান্না করেন। আশপাশের সবাইও কান্না করে। অতঃপর তিনি বলেন, আমার রবের কাছে মায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন করি। আমাকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। তাঁর কবর জিয়ারতের আবেদন করলে অনুমতি দেওয়া হয়। অতএব তোমরা কবর জিয়ারত করো। কেননা তা তোমাদেরকে মৃত্যুর কথা স্মরণ করাবে।’ (মুসলিম, হাদিস : ৯৭৬)

বারা বিন আজেব (রা.) বর্ণনা করেন, আমরা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। এমন সময় একটি দলকে দেখেন তিনি। তিনি বললেন, তারা কেন সমবেত হয়েছে? কেউ বলল, তারা কবর খুঁড়ছে। রাসুল (সা.) চিন্তিত মনে দ্রুত পায়ে গিয়ে কবরের দিকে ঝুঁকলেন। তিনি কী করেন তা দেখতে আমিও তাঁর সামনে গেলাম। তিনি প্রচণ্ড কান্না করেন। অশ্রুতে মাটি ভিজে যায়। অতঃপর আমাদের কাছে এসে বললেন, ভাইয়েরা, এ দিনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করো।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪৩৩৫)

 

সন্তানের শোকে রাসুলের কান্না : আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) নিজ সন্তান ইবরাহিমকে কোলে নিয়ে চুমু খেলেন ও সুগন্ধি নিলেন। কয়েক দিন পর আমরা আবার ওখানে যাই। তখন ইবরাহিমের মুমূর্ষু অবস্থা। রাসুল (সা.)-এর দুচোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। তখন আবদুর রহমান আউফ (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনিও (কান্না করছেন)? রাসুল (সা.) বললেন, হে ইবনে আউফ, তা রহমতস্বরূপ। এরপর বললেন, চোখ অশ্রুসিক্ত। অন্তর ব্যথিত। আমরা কেবল আমাদের রবের সন্তুষ্টিদায়ক কথাই বলব। হে ইবরাহিম, আমরা তোমার বিচ্ছেদে ব্যথিত।’ (বুখারি, হাদিস : ১৩০৩)

ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল এক মুমূর্ষু মেয়েকে কোলে তুলে নেন। বুকে রাখা অবস্থায় মেয়েটি মারা যায়। তখন উম্মে আয়মান চিৎকার করে ওঠে। কেউ বলল, তুমি রাসুল (সা.)-এর সামনে কান্না করছ? উম্মে আয়মান বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমি কি আপনাকে কাঁদতে দেখিনি? রাসুল (সা.) বলেন, আমি কান্না করি না; বরং তা বিশেষ রহমত। মুমিন সর্বাবস্থায় ভালো থাকে। সে আল্লাহর প্রশংসা করা অবস্থায় তার রুহ বের হয়।’ (ইবনে হিব্বান, হাদিস : ২৯১৪)

 

উম্মতের জন্য রাসুলের কান্না : আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইবরাহিম (আ.)-এর কথা তিলাওয়াত করলেন, ‘হে আমার রব, তারা বহু মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে, তাই যারা আমার অনুসরণ করবে তারা আমার দলভুক্ত, আর যারা আমার অবাধ্য হবে (তাদের ব্যাপারে) আপনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৩৬ )

আর ঈসা (আ.) বলেছেন, আপনি তাদের আজাব দিলে তারা আপনার বান্দা, আর ক্ষমা করলে আপনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ১১৮)

অতঃপর রাসুল (সা.) দুই হাত তুলে বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমার উম্মত! আমার উম্মত!’ আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে জিবরাইল, মুহাম্মদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করো, আপনি কাঁদছেন কেন?’ মহান আল্লাহ সব কিছুই অবগত আছেন। জিবরাইল (আ.) এসে জিজ্ঞেস করল। রাসুল (সা.) তাঁকে নিজের কথা বলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে জিবরাইল, তুমি মুহাম্মদের কাছে গিয়ে বলো, আমি শিগগির আপনার উম্মতের ব্যাপারে আপনাকে সন্তুষ্ট করব এবং আমি আপনাকে কষ্ট দেব না।’ (মুসলিম, হাদিস : ২০২)

0Shares

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ