নানা কৌশলে মাটি পাচার, সমতল ভূমিতে পরিণত হচ্ছে পাহাড়-টিলা

প্রকাশিত: ৯:৫৫ অপরাহ্ণ, জুন ৭, ২০২৩

নানা কৌশলে মাটি পাচার, সমতল ভূমিতে পরিণত হচ্ছে পাহাড়-টিলা

ডায়াল সিলেট ডেস্ক : পাহাড়-টিলায় সমৃদ্ধ বড়লেখা উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে নানা কৌশলে টিলার মাটি পাচারের কারণে ক্রমশ সমতল ভূমিতে পরিণত হচ্ছে পাহাড়ি এলাকা। রেকর্ডপত্রে অনেক ভূমির শ্রেণী ‘টিলা’ কিংবা ‘পাহাড়’ লিখা থাকলেও বাস্তবে প্রভাবশালীরা সেখানকার মাটি পাচার করে গড়ে তুলেছে খেলার মাঠ, কোন প্রতিষ্ঠান কিংবা বাড়িঘর। এতে দেখা দিচ্ছে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস, ভূমিধস ও ভূমিকম্পে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা। নির্বিচারে পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে এখনই সচেতন হওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
অপরদিকে নির্বিচারে প্রাকৃতিক ঝোপঝাড় ও বুনোফলের গাছ, লতা ধ্বংস করায় বিপন্ন হয়ে পড়ছে প্রাণীকুল। টিলা কাটায় বনাঞ্চলে খাদ্য এবং উপযুক্ত আশ্রয়স্থলের সংকট সৃষ্টি হওয়ায় প্রায়ই জনবসতিতে এসে মানুষের হাতে হতাহত হচ্ছে, বনবিড়াল, মেছোবাঘ, হরিণ, বানরসহ নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী।
গত শনিবার উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউপির চন্ডিনগর গ্রামের একটি বাড়ি থেকে মেছোবিড়াল উদ্ধার করা হয়েছে। পরে এটিকে মাধবকুণ্ড ইকোপার্কে অবমুক্ত করা হয়। এরআগে উপজেলার পৃথক এলাকায় কয়েকটি লজ্জাবতী বানর লোকালয়ে ধরা পড়ে। এছাড়া দক্ষিণভাগ, কাঠালতলী এবং শাহবাজপুরের বিভিন্ন এলাকায় খাদ্য ও আশ্রয় সংকটের কারণে বড় দল বেঁধে বন্য বানর গ্রামাঞ্চলে ঢুকে পড়ে। এরা প্রায়ই মানুষের ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে আক্রমণ চালায়।
জানা গেছে, উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর, দক্ষিণ শাহবাজপুর, বড়লেখা সদর, নিজ বাহাদুরপুর, দক্ষিণভাগ উত্তর ও দক্ষিণভাগ দক্ষিণ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে টিলা কাটা হচ্ছে। এছাড়া উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর, উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকার ছড়া থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। মাঝে মধ্যে প্রশাসনের অভিযানে জেল-জরিমানা দেওয়া হয়। এরপরও বেশিরভাগ সময় নানা কৌশলে টিলা কাটা চলে। কোথাও রাতের আঁধারে টিলা কাটা হয়। অভিযোগ রয়েছে প্রাকৃতিক টিলা কর্তনে কতিপয় জনপ্রতিনিধি ও শাহবাজপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশের সম্পৃক্ততা রয়েছে। স্থানীয় লোকজন জানান, শুধু মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে পাহাড়-টিলা রক্ষা করা সম্ভব নয়। ক্ষয়ক্ষতির দিক ও আইন সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করতে প্রচারণা চালাতে হবে।
প্রাণ-প্রকৃতি গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, ‘মৌলভীবাজার প্রাণ-বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ একটি বিশেষ অঞ্চল। এই অঞ্চলের পর্যটন, প্রাণ-প্রকৃতি কিভাবে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে এখন পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি কোন পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। শুধু বড়লেখা নয়, জেলার পাহাড়-টিলার অবস্থা এতই খারাপ যে এসব পাহাড়-টিলা কাটায় লতানো, গুল্মজাতীয় গাছ একদম কমে গেছে। এখানে টিলা-বন-পাহাড় কাটায় এই অঞ্চলের বন্যপ্রাণীরা প্রতিনিয়ত তাদের খাদ্যের উৎস হারাচ্ছে, বাসস্থান হারাচ্ছে, লোকালয়ে চলে এসে মারা যাচ্ছে। একই সাথে বন্যপ্রাণীর সাথে মানুষের দ্বন্ধও তৈরি হচ্ছে।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (মৌলভীবাজার) মাঈদুল ইসলাম জানান, ‘জেলা সদর থেকে বড়লেখার দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। এই উপজেলার পাহাড়-টিলা প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত। আমরা টিলা কাটার খবর পেলেই সেখানে অভিযান চালাই। টিলা কাটার অভিযোগে গত মাসের ৮ মে উপজেলার নিজ বাহাদুরপুর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ইমাম উদ্দিন হিফজুর, তার ভাই রাজু আহমদ, আমেরিকা প্রবাসী আব্দুল কাদিরকে শোকজ করা হয়। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া বড়লেখায় গত ১০ মাসে পরিবেশ আইনে ৪টি মামলা এবং ৮ জনকে ৭ লাখ ৬৮ হাজার ২৫০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।’
বড়লেখা ইউএনও সুনজিত কুমার চন্দ জানান, ‘পাহাড় ও টিলা কাটা বন্ধে উপজেলা প্রশাসন কঠোর। প্রায়ই অভিযান চালানো হয়। গত এক বছরে বড়লেখায় টিলা কাটা বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত ১৫টি মামলায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা জরিমানা ও ৬ জনকে জেল দিয়েছে। নিয়মিত মামলা হয়েছে ৬টি।’

0Shares