গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের মালিক হচ্ছেন জনগণ, নতুন নির্বাচন দাবি ড.মুহম্মদ ইউনূসের

প্রকাশিত: ৫:০০ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ২৭, ২০২৪

গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের মালিক হচ্ছেন জনগণ, নতুন নির্বাচন দাবি ড.মুহম্মদ ইউনূসের

ডায়ালসিলেট ডেস্ক :: বাংলাদেশে সহিংসতায় দেশে ১০ দিনে নিহত ৩’শ এর বেশী। এতে সারাদেশে মামলা হয়েছে ৫৫৫টি মামলা হয়েছে । গ্রেফতার করা হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার জন। আটককৃতদের অনেককে পুরনো মামলাতেও গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে।

 

 

এমন পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধানে একটি নতুন নির্বাচন দাবি করেছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাংলাদেশি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

 

 

তিনি বলেছেন, গণতন্ত্রে সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে একটি প্রকৃত, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। কোটা আন্দোলনকারীরা কাউকে হত্যা করতে যাননি। নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। এজন্য তিনি পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য বিদেশিদের কাছে সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন। এই মুহূর্তে সরকারের এমন কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।

 

 

 

তিনি বলেন, এর অর্থ এই নয় যে, বিদেশিরা অনানুষ্ঠানিকভাবে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে সমস্যার সমাধানে সহায়তা করবেন। বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ড বন্ধে তিনি বিদেশিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

 

 

আজ বাংলাদেশে যা ঘটছে এমনও হতে পারে ভারতেও তা ঘটতে পারে। যদি আপনি এখন কথা না বলেন, তাহলে এই দিনকে আপনি ভারত, নেপাল, পাকিস্তান অথবা সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোর খুব কাছে নিয়ে যাচ্ছেন।

 

 

 

ভারতের প্রভাবশালী দ্য হিন্দুকে দেয়া দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বর্তমানে অলিম্পিক গেমসের স্পেশাল গেস্ট হিসেবে তিনি প্যারিসে অবস্থান করছেন। সেখানে সাক্ষাৎকারের সময় সাংবাদিক সুহাসিনী হায়দার ইন্টারভিউ নেন।

 

 

সুহাসিনীর প্রশ্ন করেন বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনি কি শুনেছেন আমাদেরকে যদি একটু বলেন। আপিলেট কোর্টের নতুন রায়ের পর দৃশ্যত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে।

 

 

 

ড. ইউনূস বলেন বিষয়টি এমন না যে, আমি (অলিমিপকের বিশেষ অতিথি হিসেবে প্যারিসে) আসার পরে ঘটেছে। (ঘটনার সময়) আমি সেখানে ছিলাম। কারফিউয়ের মধ্যে আমি বিমানবন্দরে গিয়েছি। পরিস্থিতিকে সরকার এমনভাবে দেখাচ্ছে যেন বিদেশি কোনো সেনা বাংলাদেশে আগ্রাসন চালিয়েছে।

 

 

তাই সেনা ও আধাসামরিক বাহিনীকে বুলেটসহ নামানো হয়েছে বিক্ষোভকারীদের দমিয়ে রাখতে। তারা তাদেরকে (ছাত্র) পরাজিত করার মুডে ছিলেন, তারা শৃঙ্খলা ফেরানোর মুডে ছিলেন না। ফলে যা ঘটেছে, সেটা কি? কেন তারা সবরকম বাহিনীকে নামিয়েছে? সরকার কি একটি বিদেশি শক্তি যে বুলেট দিয়ে স্থানীয়দের দমন করছে? তারা তো আপনার নিজের দেশের নাগরিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তারা তো সমাজের শীর্ষ শতকরা একভাগ।

 

 

 

তারা দেশকে পরিচালনা করতে প্রস্তুত। তারা যেন অন্য দেশের শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে আগ্রাসন চালাচ্ছে, তাই তাদেরকে আপনি হত্যা করছেন। দেখামাত্র গুলি করা হচ্ছে। সুতরাং এটাই হলো পরিস্থিতি, যা বাংলাদেশে উদ্ভব হয়েছে। তাই আমি বিশ্বনেতাদের প্রতি অনুরোধ করেছি এটা দেখতে যাতে এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা যায়।

 

 

এ দৃশ্য আমি আর দেখতে পারছিলাম না। বাংলাদেশের মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ সন্ত্রাসের মধ্যে বসবাস করছে। এটা দেখতে পারছিলাম না। গণতন্ত্র সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয় জনগণের জীবনে।

 

 

 

গণতন্ত্র হলো জনগণকে সুরক্ষা দেয়া। সব মানুষকে- ধর্ম, রাজনৈতিক মতামত অথবা অন্য যেকোনো মতবিরোধ থাকলেও তাদেরকে সুরক্ষা দেয়া হলো গণতন্ত্র। যদি একজন নাগরিক অন্য একজনকে হত্যা করতে যায়, তাহলে যিনি হামলার শিকার হচ্ছেন তাকে সুরক্ষিত রাখা হলো রাষ্ট্রের প্রথম দায়িত্ব।

 

হামলাকারীকে হত্যা করা হলো এক্ষেত্রে শেষ বিকল্প, প্রথম নয়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার সেভাবেই সাড়া দিয়েছে। বিক্ষোভকারীরা কাউকে হত্যা করতে যাননি। তাদের দাবি সরকারের জন্য সন্তোষজনক না-ও হতে পারে। কিন্তু তাতেও তাদেরকে হত্যা করার অনুমোদন দেয় না সরকারকে।

 

এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে, জাতিসংঘকে জড়িত হওয়ার আহ্বান বা তারা কি পদক্ষেপ নেবে বলে সে বিষয়ে জানতে চাইলে

 

 

ড. ইউনূস বলেন, কোনোরকম আনুষ্ঠানিক সাড়া পেতে চাইনি। আমি আশা করেছিলাম, তারা (আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়) তাদের অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক এবং চ্যানেল ব্যবহার করে আমাদের নেতাদের বিরত রাখতে পারবেন। গণতন্ত্রের আদর্শ থেকে সরে যাওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে তাদের অবহিত করবেন।

 

 

বন্ধুপ্রতিম অ্যাকশনের দিকে শুধু ফোন হাতে নিয়ে বলতে পারতেন- বাংলাদেশে কি ঘটছে? বন্ধু বন্ধুর জন্য যা করে তা হলো পরিস্থিতিকে ঠাণ্ডা করা, যা জনগণের জীবন রক্ষায় সহায়ক হয়। নেতাদের বন্ধু আছেন। বন্ধু হিসেবে কিছু করা যায়। সংকটের সময়ে যদি আপনি ভালো পরামর্শ না দেন, তাহলে আপনি কেমন বন্ধু।

 

 

ড. ইউনূস আরো বলেন, আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে আপনি কি ব্যবস্থা নেবেন তার একটা প্রক্রিয়া আছে। কোথাও বলা নেই যে, আপনি একের পর এক তাদেরকে হত্যা করতে পারেন। বিশ্বে এটাই প্রথমবার নয়, যেখানে একটি সরকার বিক্ষোভকারীদের মোকাবিলা করছে। নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের হাত উত্তোলিত থাকা অবস্থায় তাদেরকে খুব কাছ থেকে গুলি করতে দেখেছি পুলিশকে। কারণ, এই পুলিশকে গুলি করে হত্যার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আমরা এ সবই দেখছি। বিক্ষোভকারীরা যদি আইনভঙ্গ করেন তাহলে এমন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য মানসম্পন্ন প্রক্রিয়া আছে। বাংলাদেশে আইনের শাসন ও গণতন্ত্র চর্চার মধ্যে কিছু ভয়াবহ ভুল আছে।

 

 

আমাদের মুখ ফিরিয়ে নেয়া ঠিক হবে না। আমরা সার্কের সদস্য। আমরা প্রতিবেশী। কী ঘটছে তা দেখতে সব মিডিয়ার আসা উচিত ও দেখা উচিত। সবার আগে তারা (বাংলাদেশ সরকার) যেটা করেছে তা হলো সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছে, যাতে অন্ধকারে তারা সবকিছু ধামাচাপা দিতে পারে। দেশের বাইরে থেকে এমন কি দেশের ভিতর থেকে কেউ যেন কিছু দেখতে না পায়। কেন তারা নিজেদের জনগণ থেকে এত ভীত?

 

তিনি বলেন, এসব হলো শিক্ষার্থীদের দাবি। এসব বিষয়ে সরকার সাড়া দিয়েছে। এটা সেভাবে হয়নি।

 

 

গণতন্ত্রের প্রতি আমরা প্রতিশ্রুতিবন্ধ এবং গণতন্ত্র নিয়েই থাকতে চাই। আপনি ফ্রেশ নির্বাচিত হোন বা না হোন, অথবা জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে আপনার পদের লঙ্ঘন করছেন, গণতন্ত্রে এটা কোনো বিষয় নয় যে- আপনি জনগণকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাদেরকে হত্যার নয়।

 

বিরোধী দলের কিছু মানুষকে তুলে নিয়ে যেতে পারেন না, যাতে তাকে গ্রেপ্তার করা যায়। একটি কল্পিত ক্রাইমে তাকে অভিযুক্ত করতে পারে সরকার, গ্রেপ্তার করতে পারে। তাকে জেল দেয়া হতে পারে। এটা আইনের শাসন নয়। গণতান্ত্রিক আদর্শে কোনো প্রক্রিয়া চালানোর কিছু নিয়ম আছে।

 

 

যদি গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়, তাহলে আপনি আবার জনগণের কাছে তাদের ম্যান্ডেট নিতে যেতে পারেন। সেটা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু এই মুহূর্তে সরকারের এমন কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। গণতান্ত্রিক কাঠামোর অধীনে এমন পরিস্থিতির উদয় হলে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হয়। সব সমস্যার সমাধান আছে গণতন্ত্রে।

 

 

 

আমি এখন সেই ভূমিকাই রাখছি। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করছি।

 

 

আইনের শাসনের ব্যর্থতা নিয়ে ড. ইউনুস বলেন আমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো হলো আত্মসাৎ, জালিয়াতি এবং অর্থ পাচার সম্পর্কিত। এর অর্থ হলো- আমার নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে আমি অর্থ চুরি করেছি। এসব সরকারের অভিযোগ। এ সবই বানোয়াট কাহিনী, সবই বানানো।

 

অনেক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন বলেছে, এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। এসব মামলা করা হয়েছে আমাকে হয়রান করার জন্য। শ্রম অধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কিত মামলায় এরই মধ্যে আমাকে ৬ মাসের জেল দেয়া হয়েছে। এটিও একটি বানোয়াট মামলা।

 

 

 

জনগণের ম্যান্ডেট নিন রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, সরকারে থাকা কিছু মানুষের জন্য নয়। সব রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হলো নির্বাচন। যখন কোনো বিষয় কাজ করে না, তখন আপনাকে জনগণের কাছে যেতে হয় তাদের নির্দেশনা পেতে। নিশ্চিত করতে হবে যে, সেই নির্বাচন একজন জাদুকরের নির্বাচন না হয়ে হবে একটি খাঁটি নির্বাচন।

 

 

সরকার দাবি করছে যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে, মৌলিক রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। অস্থায়ী ভিত্তিতে হয়তো থেমে আছে। কিন্তু রাজনৈতিক ইঞ্জিন দৌড়াতেই থাকবে। তা মুহূর্তের নোটিশে নতুন করে শুরু হয়ে যেতে পারে।

 

আজ বাংলাদেশে যা ঘটছে এমনও হতে পারে ভারতেও তা ঘটতে পারে। যদি আপনি এখন কথা না বলেন, তাহলে এই দিনকে আপনি ভারত, নেপাল, পাকিস্তান অথবা সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোর খুব কাছে নিয়ে যাচ্ছেন। তাই দেশকে বাচাতে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার।

 

 

 

0Shares