প্রকাশিত: ৯:২৮ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ৭, ২০২১
ডায়ালসিলেট ডেস্ক;:বন্ধ গণপরিবহন। বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা। হেঁটে গন্তব্যে ছুটছে মানুষ। পথে পথে দুর্ভোগ। সীমাহীন কষ্ট। ভোগান্তির শিকার অফিসগামী ও বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার্থীরা। জনজীবনে নেমেছে অস্বস্তি। মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছালেও দাবি আদায়ে অনড় পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সংগঠনগুলো। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে গতকালও পালিত হয়েছে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘট। এতে বন্ধ থাকে গণপরিবহন। ঢাকার মধ্যে চলাচল করেনি কোনো বাস। রাজধানী ছেড়ে যায়নি আন্তঃজেলার গণপরিবহন। গত ২ দিনেও ঘোরেনি পণ্যবাহী পরিবহনের চাকা। এতে অচল হয়ে পড়েছে গোটা যোগাযোগ খাত। চরম বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। গতকাল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকলেও বাস বন্ধ থাকায় নির্ধারিত সময়ে অফিসে যেতে পারেননি অনেকে। বিভিন্ন শিক্ষপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষা থাকলেও অনেকে অংশ নিতে পারেননি। যারা অংশ নিয়েছেন তারাও নানা ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর জন্য ডিজেলের দাম বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে ডাকা এ ধর্মঘটে জনজীবনে নেমে এসেছে দুর্দশা। ভাড়া দ্বিগুণের দাবিতে অঘোষিত ধর্মঘট ডেকেছে লঞ্চ মালিক সমিতি। শনিবার দুপুরে লঞ্চ মালিকদের সংগঠনের জরুরি বৈঠকে লঞ্চ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন মালিকরা। টার্মিনাল থেকে লঞ্চগুলো অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন তারা।
শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনেও রাস্তায় বের হয়নি গণপরিবহন। সড়কে বেড়েছে ব্যক্তিগত গাড়ি, রিকশা, মোটরসাইকেল, সিএনজি ও অটোরিকশা। বাস না থাকায় অফিসগামীরা বিকল্প উপায়ে যাতায়াত করেছেন। অনেকেই ৩ থেকে ৪ গুণ বাড়তি ভাড়ায় এসব বাহনে করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছেন। বাড়তি ভাড়ার কারণে অনেকে হেঁটে যাতায়াত করেছেন। এ নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মানুষের দুর্ভোগ কমাতে বিআরটিসি বাস চলাচল করলেও এর সংখ্যা ছিল সীমিত। দীর্ঘক্ষণ পরপর বিআরটিসি বাস এলেও চলে প্রতিযোগিতা। যাত্রীদের মাঝে চলে ধাক্কাধাক্কি, ঠেলাঠেলি। অনেকেই বাসে ঝুলে যাতায়াত করেছেন। অনেকে বলছেন, দেশের মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। দফায় দফায় বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম।
বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে মানিকগঞ্জ থেকে আসা জয়দেব সাহা বলেন, বাস নেই। ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে করে ভেঙে ভেঙে ঢাকায় এসেছি। অনেক কষ্ট হয়েছে। আসার পথে সারাক্ষণ চিন্তিত ছিলাম। ভোগান্তির ফলে পরীক্ষায়ও ভালো করতে পারিনি। এজন্য কাকে দায়ী করবো। আমার মতো অনেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভোগান্তির শিকার হয়ে পরীক্ষা দিতে এসেছে। এখন কীভাবে আমরা ফিরে যাবো তার জন্য চিন্তিত। বাস থাকলে এত কষ্ট হতো না।
সকালে রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় দেখা যায়, বাস না পেয়ে ফুটপাথ ধরেই হেঁটে যাচ্ছেন অফিসগামীরা। অনেকে বাড়তি ভাড়ায় রিকশা ও সিএনজিতে উঠেছেন। বিআরটিসি বাসে ঠাসাঠাসি উঠছেন যাত্রীরা। বাংলামোটর পুলিশ বক্সের সামনে অপেক্ষা করেছেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও বিআরটিসি বাসে উঠতে পারেননি। তিনি বলেন, আমার অফিস সাইনবোর্ড এলাকায়। কোনো বাস পাচ্ছি না। মাঝে মধ্যে বিআরটিসি বাস এলেও যাত্রীদের চাপের কারণে উঠতে পারিনি। সিএনজি ভাড়াও ৪-৫ গুণ বেশি চাইছে। এতে বেশি ভাড়া দিয়ে অফিসে যাওয়ার মতো আমার সামর্থ্য নেই। বয়স্ক হওয়ার কারণে হাঁটতেও পারছি না। মহাবিপাকে পড়েছি। সব কিছু ঊর্ধ্বগতির মুখে বাস ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে অঘোষিত ধর্মঘট জনজীবনে ভোগান্তি সৃষ্টি করেছে। বাস বন্ধ থাকার সুযোগটা রিকশা ও সিএনজি চালকরা কাজে লাগাচ্ছে। তারা মানুষকে ঠেকিয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে।
রাজীব নামের একজন বলেন, বৃহস্পতিবার গ্রামের বাড়ি গাজীপুর গিয়েছিলাম। পরে রাতে জানতে পারলাম অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাস বন্ধ থাকবে। এতে বিপাকে পড়ি। শনিবার অফিস খুলেছে। এজন্য ভোর রাতে গাজীপুর থেকে রওয়ানা দিয়েছি। ২ বার মোটরসাইকেল ও ৩ বার রিকশা পরিবর্তন করে মগবাজার পৌঁছাই। এতে আমার ১১০০ টাকা খরচ হয়েছে। কোথাও বাস নেই। রিকশা ও ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলের চালকরা ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ হিসেবে বাস মালিকদের এমন সিদ্ধান্তে নগরবাসীকে শাস্তি দিচ্ছে।
সাভারের বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম। সকালে তার ৬০ বছর বয়সী মা রেহানা বেগমকে নিয়ে মগবাজারের একটি বস্তি থেকে বের হয়েছেন। বাস না থাকায় মগবাজার ওয়ারলেস গেটে সিএনজির জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে মা আমার বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। এখানে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই তাকে নিতে এসেছি। এখন বাস নেই। সিএনজির জন্য অপেক্ষা করছি। ভাড়া বেশি চাইছে। এখন কি করবো বুঝতে পারছি না। বাস না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছি।
সায়েদাবাদ এলাকায় নাজনীন আক্তার নামে এক গার্মেন্টকর্মী বলেন, শনিবার রাতে আমার ছোট বোনের বিয়ে। বাড়ি থেকে হঠাৎ ফোন করে জানিয়েছে, সন্ধ্যার আগেই বাড়িতে যেতে হবে। এখানে এসে দেখি কোনো গাড়ি নেই। সব বন্ধ করে রাখা হয়েছে। নোয়াখালীর সেনবাগে কীভাবে সন্ধ্যার আগে পৌঁছাবো। এমনিতে সকালে রামপুরা থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত রিকশায় ১২০ টাকায় এসেছি। বাসের লোকজন বলছেন বাস ছাড়বে না। আমি মহিলা মানুষ। বিকল্প উপায়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ধর্মঘট ডেকে দেশের মানুষকে বিপদে ফেলছে বাসের মালিকরা।
এদিকে দুপুরে মহাখালী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, সড়কের পাশে সারি সারি রাখা হয়েছে আন্তঃজেলার বাস। সেখানে দেশের বিভিন্ন জেলায় যেতে আগ্রহীরা অপেক্ষা করছেন। অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
কয়েকজন জানান, ধর্মঘট চলছে এটা জানেন তারা। তবে জরুরি কাজে তাদেরকে ঢাকার বাইরে যেতে হবে। বাস বন্ধ থাকায় তারা যেতে পারছেন না। এতে আর্থিক ও পারিবারিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তারা।
জসিম উদ্দিন নামের একজন বলেন, জরুরি কাজ তো আর ধর্মঘট বুঝে না। এখন কোথাও যেতে পারছি না। বাস বন্ধ করে জনগণকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। এমনিতে বাসে সব সময় নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি নেয়। এখন যদি ভাড়া আরও বাড়ায় তাহলে আমরা অনেক ক্ষতির মুখে পড়বো।
এদিকে বাস ধর্মঘটের কারণে দুর্ভোগে পড়েছেন রোগীরা। অনেকেই পরিবহন সংকটের কারণে হাসপাতালে যেতে পারেননি। একই সমস্যায় পড়েছেন চিকিৎসকসহ হাসপাতালের স্টাফরাও। ভোলার চরফ্যাশন থেকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা আবদুল জলিল বলেন, ধর্মঘটের মধ্যেই ডাক্তার দেখানোর সিরিয়াল ছিল। সকালে লঞ্চ থেকে নেমে ৩০০ টাকা ভাড়ায় রিকশায় করে হাসপাতালে এসেছি। এখন শুনি লঞ্চ বন্ধ। কীভাবে ভোলায় যাবো। ঢাকায় পরিচিত কেউ নেই। যে টাকা নিয়ে এসেছি ডাক্তার ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় খরচ হয়ে গেছে। এখন থাকবো কোথায়? হঠাৎ করে বাস লঞ্চ সব বন্ধ হয়ে গেলে মানুষ যাতায়াত করবে কীভাবে। দেশের মানুষকে জিম্মি করে এভাবে দাবি আদায়ের কোনো যৌক্তিকতা নেই। পরিবহনে সেবা না দিয়ে উল্টো যাত্রীদেরকে ভোগান্তিতে ফেলা হয়েছে। আমার মতো হাজার হাজার মানুষ লঞ্চঘাট থেকে এসে ফিরে যাচ্ছেন। অনেকেই লঞ্চঘাটে অপেক্ষা করছেন। ঘাটে কোনো লঞ্চ নেই। সকালে দেখলাম আর দুপুরে উধাও।
এদিকে হঠাৎ করে লঞ্চ বন্ধ করে দেয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন কয়েক লাখ লঞ্চযাত্রী। দুপুর থেকে হাজার হাজার লঞ্চযাত্রী ঘাটে পৌঁচ্ছালেও লঞ্চ না ছাড়ায় তাদের কেউই গন্তব্যে যেতে পারেননি। এতে অনেক অসুস্থ ও অফিসগামী মানুষ বিপাকে পড়েছেন। তাদের অনেকেই বলছেন- প্রয়োজনীয় কাজে কিংবা অসুস্থতাজনিত কারণে ঢাকায় এসেছেন। হঠাৎ লঞ্চ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা আটকা পড়েছেন। বরিশাল, ভোলা, হাতিয়া, মনপুরা ও চরফ্যাশনে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম লঞ্চ। ফলে অন্য কোনো উপায় না থাকায় অনেকেই সদরঘাট টার্মিনালে অবস্থান করছেন।
এদিকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন (যাত্রী) এসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা ধর্মঘটের ডাক দেইনি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় মালিকরা লঞ্চ চালাতে চাচ্ছেন না। তারা স্বপ্রণোদিত হয়ে ঘাট থেকে লঞ্চ সরিয়ে নিচ্ছেন। তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পূর্বের ভাড়া অনুযায়ী লঞ্চ চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
বাস মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনগুলো বলছে, সরকার তাদের দাবি না মানলে ধর্মঘট চলবে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় মালিকরা ঝুঁকি নিয়ে বাস চালাতে চাচ্ছেন না। তাদের দাবি গত কয়েক বছর ধরে সরকার ভাড়া বাড়াচ্ছে না। যন্ত্রপাতির দাম বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খাতে ক্ষতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ জন্য নতুন করে ভাড়ার সমন্বয় চাচ্ছেন তারা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ জানান, তার সংগঠন থেকে ধর্মঘট ডাকা হয়নি। পরিবহন মালিকরা চলমান ভাড়ায় গাড়ি চালাতে চাচ্ছেন না। তেলের দাম বাড়ায় এই সময় তারাও বিপাকে পড়েছেন। তিনি বলেন, বাস চালাতে আমরা বিআরটিএর সঙ্গে বৈঠক করতে চেয়েছি। তাদেরকে আমরা চিঠি দিয়েছি। আজ রোববার বিআরটিএর সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে আমাদের দাবি মানা হলে পরবর্তীতে বাস চলবে। বৈঠক চলাকালীন সময়েও বাস চলাচল বন্ধ রাখবে মালিকরা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান রাঙ্গা মানবজমিনকে বলেন, মালিকরা বাস বন্ধ রেখেছে। আমরা চাচ্ছি দ্রুত এর একটা সমাধান হোক। বিআরটিএর সঙ্গে আমরা প্রথম দিন থেকেই বৈঠক করে ভাড়া সমন্বয়ের কথা বলে আসছি। বিআরটিএ আমাদেরকে রোববার সময় দিয়েছে। আমার সংগঠনের মহাসচিব বৈঠকে অংশ নেবেন। আমরা চাই একটা সমাধান আসুক। দেশের মানুষের কষ্ট লাঘব হোক। জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। ভারতও তেলের দাম কমিয়েছে। আমাদের দেশে বাড়ছে। এতে জনজীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে। সব কিছুর ওপর এর প্রভাব পড়বে।
ডায়ালসিলেট এম/
Address: Kaniz Plaza, Zindabazar, Sylhet
United Kingdom, London Mobile :+447438548379
dialsylhetnews@gmail.com
Design and developed by AshrafTech